অদেখা মায়ার জাল
রিমির বয়স বাইশ। সদ্য কলেজ পাশ করে একটা বেসরকারি সংস্থায় কাজ শুরু করেছে। স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটই তার সব অবসর বিনোদনের সঙ্গী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার দারুণ সক্রিয়তা, বিশেষ করে ইনস্টাগ্রামে তার প্রচুর ফলোয়ার। নিজের ছবি, ঘুরতে যাওয়ার ছবি, বন্ধুদের সাথে আড্ডার ছবি—সবকিছুই সে নিয়মিত পোস্ট করত।
একদিন তার ইনস্টাগ্রাম ইনবক্সে একটি মেসেজ এল। প্রোফাইল পিকচারে সুদর্শন এক যুবক, নাম আকাশ মালহোত্রা। আকাশ নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিল। বিদেশে তার বড়সড় ব্যবসা, আর সে নাকি রিমির প্রোফাইল দেখে ভীষণ মুগ্ধ। তার পোস্টগুলো নাকি খুব অনুপ্রেরণামূলক মনে হয়েছে তার কাছে।
রিমি প্রথমদিকে তেমন পাত্তা দেয়নি, কিন্তু আকাশের মেসেজ আসা বন্ধ হলো না। সে নিয়মিত রিমির ছবিগুলোর প্রশংসা করত, তার লেখা পোস্টগুলোতে সুন্দর মন্তব্য করত। ধীরে ধীরে রিমিও আগ্রহী হয়ে উঠল। আকাশের কথা বলার ধরন, তার বুদ্ধিমত্তা, আর তার সফল জীবনের গল্প রিমিকে মুগ্ধ করতে লাগল। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাট করত, কখনো ভয়েস কলও করত। আকাশ বারবার বলত, সে রিমির সাথে দেখা করতে চায়, কিন্তু তার ব্যবসার কাজে সে ভীষণ ব্যস্ত, তাই এখনই আসা সম্ভব হচ্ছে না।
কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সম্পর্ক বেশ গভীর হয়ে উঠল। রিমি আকাশের প্রেমে পড়েছিল। আকাশ তাকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাত, একসাথে বিলাসবহুল জীবন কাটানোর কথা বলত। রিমির পরিবার বা বন্ধুদের কাছেও আকাশকে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করত।
একদিন আকাশ জানাল, তার ব্যবসার একটি বড় সমস্যা হয়েছে। একটি বিশাল অঙ্কের টাকা আটকা পড়ে গেছে, আর তা ছাড়ানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু টাকার প্রয়োজন। সে রিমিকে বোঝাল, এটা সাময়িক সমস্যা, টাকাটা পেলেই সে কয়েকদিনের মধ্যে সব ফেরত দিয়ে দেবে, এমনকি রিমির জন্য একটি দামী উপহারও কিনবে।
রিমি দ্বিধায় পড়ে গেল। তার কাছে জমানো সামান্য কিছু টাকা ছিল, কিন্তু সেটা আকাশের চাওয়া টাকার তুলনায় খুবই কম। সে তার মায়ের কাছে গেল এবং মিথ্যে করে বলল যে, তার এক বন্ধুর খুব জরুরি প্রয়োজনে টাকার দরকার। মা মেয়েকে বিশ্বাস করে কিছু টাকা দিলেন, সাথে রিমির জমানো টাকা মিলিয়ে সে আকাশের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিল।
টাকা পাওয়ার পর আকাশ আগের মতোই কথা বলতে লাগল, কিন্তু তার মেসেজের সংখ্যা কমে গেল। "খুব ব্যস্ত আছি," "পরে কথা বলছি,"—এই ধরনের উত্তর আসতে লাগল। রিমি চিন্তায় পড়ে গেল। দু'দিন পর আকাশ পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল। তার প্রোফাইল ডিঅ্যাক্টিভেট হয়ে গেল, মেসেজ বা কল কোনো কিছুরই উত্তর নেই।
রিমি বুঝতে পারল, সে এক ভয়ংকর প্রতারণার শিকার হয়েছে। তার জমানো টাকা এবং মায়ের দেওয়া টাকা, সব চলে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, তার বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। বন্ধুদের সাথেও কথা বলতে পারছিল না, কারণ তাদের কাছেও সে আকাশের গল্প বলেছিল।
রিমি অবশেষে পুলিশের কাছে গেল। কিন্তু যেহেতু সব লেনদেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে হয়েছিল এবং আকাশের কোনো সঠিক তথ্য ছিল না, তাই তাকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। রিমি শিখল এক কঠিন শিক্ষা। অনলাইন সম্পর্ক যতই মধুর হোক না কেন, ব্যক্তিগত তথ্য বা আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে চরম সতর্কতা প্রয়োজন। অদেখা জগতের মায়ার জালে জড়িয়ে সবকিছু হারানোর ভয় সবসময়ই থাকে।