টাইটানিক জাহাজের গোপন কাহিনী

 



টাইটানিক জাহাজের গোপন কাহিনী  টাইটানিক জাহাজের গল্প বলতে গেলে কেবল তার ডুবে যাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনাই আসে না, বরং তার বিলাসবহুল যাত্রা, ভেতরের জীবন এবং কিছু অদেখা দিকের কথাও উঠে আসে। চলুন, টাইটানিকের সেই ফুল গল্পটা জেনে নিই:

টাইটানিক জাহাজের গোপন কাহিনী :

স্বপ্নের জাহাজ: আর.এম.এস. টাইটানিক

আর.এম.এস. টাইটানিক ছিল বিশ শতকের শুরুতে নির্মিত এক বিস্ময়কর জাহাজ। এর পুরো নাম ছিল 'রয়্যাল মেল স্টিমার টাইটানিক'। এটি ছিল সে সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং বিলাসবহুল জাহাজ। প্রায় ৮৮২ ফুট লম্বা এবং ৯২ ফুট চওড়া এই জাহাজটি এতটাই বিশাল ছিল যে এর নির্মাতারা একে "আনসিংকেবল" বা "অডুবনীয়" বলে দাবি করেছিলেন। ৬০ হাজার টনের বেশি ওজনের এই জাহাজটি তৈরি করতে প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল, যা বর্তমানের হিসাবে শত শত কোটি টাকা।

বিলাসবহুল আয়োজন

টাইটানিক শুধু আকারেই বিশাল ছিল না, এর ভেতরের সজ্জাও ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য ছিল রাজকীয় স্যুুট, বিলাসবহুল ডাইনিং হল, সুইমিং পুল, জিমনেসিয়াম, স্কোয়াশ কোর্ট, টার্কিশ বাথ এবং একটি বিশাল গ্র্যান্ড স্টেয়ারকেস (প্রধান সিঁড়ি)। এই সিঁড়িটি এতটাই সুন্দর ছিল যে আজও এর ছবি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এমনকি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের জন্যও যথেষ্ট আরামদায়ক ব্যবস্থা ছিল। জাহাজটি প্রায় ৩,৫৪৭ জন যাত্রী ও ক্রু বহন করতে পারত এবং এর আলোকসজ্জার জন্য ১০ হাজারেরও বেশি বাল্ব ব্যবহার করা হয়েছিল।

প্রথম ও শেষ যাত্রা

১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল, টাইটানিক তার প্রথম এবং দুর্ভাগ্যজনক যাত্রার জন্য ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দর থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এই যাত্রায় প্রায় ২,২২৪ জন যাত্রী এবং ক্রু ছিলেন। জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন অ্যাডওয়ার্ড জন স্মিথ, একজন অভিজ্ঞ নাবিক। যাত্রার প্রথম কয়েকদিন সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। যাত্রীরা সমুদ্রের শান্ত বাতাস উপভোগ করছিলেন, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নিজেদের মতো করে সময় কাটাচ্ছিলেন। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীরা তাদের বিলাসবহুল জীবন উপভোগ করছিলেন, আর তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীরা নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর অপেক্ষায় ছিলেন।





নিয়তির আঘাত: হিমশৈল

১৪ এপ্রিল, ১৯১২ তারিখে, রাতের অন্ধকারে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে টাইটানিক তার পূর্ণ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। রাত তখন প্রায় ১১:৪০ মিনিট। জাহাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কয়েকটি হিমশৈলের (আইসবার্গ) সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন, কিন্তু জাহাজটি তখনও তার প্রায় সর্বোচ্চ গতিতেই চলছিল। হঠাৎ করে জাহাজের লুকআউট কর্মকর্তারা একটি বিশাল হিমশৈল দেখতে পান। দ্রুত গতিতে চলার কারণে এবং পর্যাপ্ত মোড় নিতে অক্ষম হওয়ায়, জাহাজটি হিমশৈলের সাথে সজোরে ধাক্কা খায়।

এই ধাক্কা ছিল ভয়াবহ। হিমশৈলটি জাহাজের ডানদিকের প্রায় ৯০ মিটার অংশ জুড়ে চিড় সৃষ্টি করে। টাইটানিক এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল যে এটি চারটি জলপূর্ণ কম্পার্টমেন্ট নিয়েও ভেসে থাকতে পারত। কিন্তু হিমশৈলের আঘাতে ছয়টি কম্পার্টমেন্ট জলপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। দ্রুতই বোঝা গেল যে জাহাজটিকে বাঁচানো সম্ভব নয়।

মর্মান্তিক পরিণতি

জাহাজ ডুবার খবর পেয়ে ক্যাপ্টেনের নির্দেশে লাইফবোট নামানোর কাজ শুরু হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত লাইফবোট ছিল না। টাইটানিকের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী ৩২টি লাইফবোট থাকার কথা থাকলেও, "অডুবনীয়" ধারণাটির প্রভাবে মাত্র ২০টি লাইফবোট রাখা হয়েছিল, যা দিয়ে মাত্র ১,১৮০ জনকে বাঁচানো সম্ভব ছিল। যাত্রীর সংখ্যা ছিল এর প্রায় দ্বিগুণ।

ঠাণ্ডা হিমশীতল আটলান্টিকের জলে জীবন বাঁচানোর জন্য শুরু হলো এক তীব্র সংগ্রাম। নারীরা ও শিশুরা প্রথমে লাইফবোটে ওঠার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু অনেকেই লাইফবোটের অভাবে বা বিশৃঙ্খলার কারণে উঠতে পারেননি। অনেকে তীব্র ঠাণ্ডা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু আটলান্টিকের সেই রাতের তাপমাত্রা এতটাই কম ছিল (প্রায় -২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) যে বেশিরভাগ মানুষই হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যান।

১৫ এপ্রিল, ১৯১২ তারিখে, রাত ২:২০ মিনিটে, যাত্রা শুরুর মাত্র ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের মধ্যে, টাইটানিক সম্পূর্ণরূপে সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে যায়। এই দুর্ঘটনায় প্রায় ১,৫০০ জনেরও বেশি যাত্রী এবং ক্রু প্রাণ হারান। এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম মর্মান্তিক সমুদ্র দুর্ঘটনা।




পরবর্তী ঘটনা ও বর্তমান অবস্থা

টাইটানিকের এই করুণ পরিণতি গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। এই দুর্ঘটনার পর জাহাজ নির্মাণ ও সুরক্ষার নিয়মনীতিতে অনেক পরিবর্তন আসে। এর ৭৪ বছর পর, ১৯৮৫ সালে, সমুদ্রের ১২,৬০০ ফুট গভীরে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করা হয়। জাহাজটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে সমুদ্রতলে পড়ে আছে। আজও, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ এবং এর সাথে জড়িয়ে থাকা গল্প মানুষের মনে এক গভীর বিস্ময় আর দুঃখের ছাপ ফেলে। এটি শুধু একটি জাহাজ ছিল না, এটি ছিল মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রকৃতির কাছে তার অসহায়ত্বের এক মর্মান্তিক প্রতীক।


টাইটানিকের অদেখা গল্পগুলো

টাইটানিক জাহাজটি যখন ডুবে যায়, তখন অসংখ্য মানুষের ব্যক্তিগত গল্পও তার সাথে ডুবে যায়। তবে কিছু গল্প আমাদের কাছে এসেছে, যা মানবতা, ত্যাগ এবং ভাগ্যের এক অনন্য চিত্র তুলে ধরে।

১. সঙ্গীতজ্ঞদের শেষ সঙ্গীত

টাইটানিকের অন্যতম মর্মস্পর্শী গল্প হলো জাহাজের সঙ্গীতজ্ঞ দলের। যখন জাহাজটি ডুবছে, যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে, ঠিক সেই সময় জাহাজের আটজন সঙ্গীতজ্ঞের একটি দল ডেকের উপর দাঁড়িয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আতঙ্কিত যাত্রীদের সাহস যোগানো এবং তাদের মনকে শান্ত রাখা। ওয়ালস হার্টলি-র নেতৃত্বে এই ব্যান্ডটি "Nearer, My God, to Thee" (আমার ঈশ্বর, তোমার আরও কাছে) গানটি বাজিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। তারা জানতেন যে তাদের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম, তবুও তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেদের কর্তব্য পালন করে গেছেন। তাদের এই আত্মত্যাগ আজও স্মরণীয়।

২. ইসিদর এবং ইডা স্ট্রস: ভালোবাসার শেষ প্রতিজ্ঞা

ইসিডর স্ট্রস এবং তার স্ত্রী ইডা স্ট্রস ছিলেন নিউইয়র্কের বিখ্যাত ব্যবসায়ী এবং Macy's ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মালিক। তারা প্রথম শ্রেণীর যাত্রী ছিলেন। যখন লাইফবোটে মহিলাদের ওঠার নির্দেশ দেওয়া হলো, ইডাকে লাইফবোটে উঠতে বলা হলো। কিন্তু ইডা তার স্বামীকে একা রেখে যেতে অস্বীকার করলেন। তিনি বললেন, "যেখানে তুমি যাবে, আমিও সেখানে যাব।" ইসিডরকে লাইফবোটে ওঠার সুযোগ দেওয়া হলেও তিনি সেই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তখনও অনেক নারী ও শিশু জাহাজে ছিল। তারা একে অপরের হাত ধরে শেষ পর্যন্ত জাহাজের ডেকেই রয়ে গেলেন এবং একসাথে প্রকৃতির কোলে বিলীন হয়ে গেলেন। তাদের এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা চিরকালের জন্য এক কিংবদন্তী হয়ে আছে।

৩. চার্লস জঘিন: মাতাল রুটিরুচির বিস্ময়কর টিকে থাকা

জাহাজের প্রধান রুটিরুচি (বেকার) চার্লস জঘিন-এর গল্পটি বেশ অদ্ভুত। জাহাজ যখন ডুবছিল, তখন তিনি প্রচুর পরিমাণে হুইস্কি পান করেন। সম্ভবত এই কারণেই তিনি চরম ঠাণ্ডা আটলান্টিকের পানিতে প্রায় দুই ঘণ্টা ভেসে থাকতে পেরেছিলেন, যখন বেশিরভাগ মানুষই হাইপোথার্মিয়ায় মারা যাচ্ছিল। মাতাল অবস্থায় তার শরীরের রক্ত সঞ্চালন বেশি ছিল এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল তার শরীরকে উষ্ণ রাখতে সাহায্য করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। তাকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তিনি প্রায় সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। এটি এক বিস্ময়কর ঘটনা, যা টাইটানিকের অন্যান্য করুণ গল্পের মাঝে একটি বিরল ব্যতিক্রম।

https://ojanapothe.blogspot.com/2025/06/blog-post_86.html

৪. মলি ব্রাউন: অডুবনীয় মলি

মার্গারেট "মলি" ব্রাউন ছিলেন টাইটানিকের একজন প্রথম শ্রেণীর যাত্রী এবং একজন সাহসী নারী। যখন জাহাজ ডুবছিল, তিনি অন্য মহিলাদের সাথে লাইফবোটে ওঠেন। কিন্তু তিনি দেখলেন যে লাইফবোটটি প্রায় খালি যাচ্ছে, অথচ আরও অনেক মানুষ পানিতে ডুবে মরছে। মলি লাইফবোটের কর্মীদের জোর করতে লাগলেন যে তারা যেন ফিরে গিয়ে আরও মানুষকে বাঁচায়। তার এই সাহসী মনোভাবের জন্য এবং এই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরার পর তার সমাজসেবামূলক কাজের জন্য তাকে "অডুবনীয় মলি ব্রাউন" নামে ডাকা হতো।

৫. জোসেফ লারোচে: টাইটানিকের একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবার

হাইতির প্রকৌশলী জোসেফ লারোচে তার ফরাসি স্ত্রী এবং দুই কন্যা সন্তান নিয়ে টাইটানিকের দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী ছিলেন। তারা আমেরিকায় নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছিলেন। টাইটানিকের যাত্রীদের মধ্যে তারাই ছিলেন একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবার। দুর্ভাগ্যবশত, জোসেফ এই দুর্ঘটনায় মারা যান, কিন্তু তার স্ত্রী এবং দুই কন্যা লাইফবোটে উঠে প্রাণে বাঁচেন। তাদের গল্প টাইটানিকের বর্ণবৈষম্যহীন পরিবেশ এবং সেই সময়ের সামাজিক কাঠামোর একটি ইঙ্গিত দেয়, যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদেরও বিলাসবহুল জাহাজে ভ্রমণ করার সুযোগ ছিল।

৬. ফ্র্যাঙ্ক গডউইন: একটি শিশুকে বাঁচানোর চেষ্টা

ফ্র্যাঙ্ক গডউইন, টাইটানিকের একজন স্টুয়ার্ড, তার লাইফবোটে থাকা অবস্থায় একটি ছোট শিশুকে বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। যখন একটি লাইফবোট পানিতে নামানো হচ্ছিল, তখন এক মা তার শিশুকে ফ্র্যাঙ্কের দিকে ছুঁড়ে দেন, এই আশায় যে শিশুটি বেঁচে যাবে। ফ্র্যাঙ্ক শিশুটিকে ধরে ফেলেন, কিন্তু লাইফবোটে ওঠার সময় তিনি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং হিমশীতল পানিতে পড়ে যান। শিশুটিকে রক্ষা করলেও, ফ্র্যাঙ্ক নিজেই সেই ঠাণ্ডা পানিতে ডুবে মারা যান। তার এই আত্মত্যাগ একটি শিশুর জীবন বাঁচিয়েছিল।


এই গল্পগুলো টাইটানিকের ট্র্যাজেডির পাশাপাশি মানুষের ভালোবাসা, সাহস, এবং মানবতা প্রদর্শনের এক জীবন্ত দলিল। এই ধরনের গল্পগুলোই টাইটানিককে শুধু একটি ডুবে যাওয়া জাহাজ নয়, বরং মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় করে তুলেছে।


টাইটানিক: আরও কিছু অজানা ও অসাধারণ গল্প

টাইটানিক শুধু একটি জাহাজ ছিল না, এটি ছিল স্বপ্ন, আশা, শ্রেণী বৈষম্য এবং নিয়তির এক বিচিত্র মিশ্রণ। এর ধ্বংসের সাথে জড়িত ছিল হাজার হাজার মানুষের ব্যক্তিগত কাহিনি।

১. মিল্টন হার্শে: যে কোটিপতি টাইটানিককে এড়িয়ে গিয়েছিলেন

চকলেট কিং মিল্টন হার্শে, হার্শে'স চকলেটের প্রতিষ্ঠাতা, টাইটানিকের প্রথম যাত্রার জন্য টিকিট কেটেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে, তিনি তার ব্যবসায়িক কাজের জন্য এবং তার স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে তাড়াতাড়ি ফেরার প্রয়োজন হওয়ায়, টাইটানিকের যাত্রা বাতিল করে একটি ভিন্ন জাহাজে (এস.এস. আমেরিকান) ফিরে আসেন। এই সিদ্ধান্তই তাকে মর্মান্তিক পরিণতি থেকে বাঁচিয়ে দেয়। তার গল্প দেখায়, ভাগ্যের সামান্য এক বাঁকবদল কীভাবে জীবন আর মৃত্যুর পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।



২. কসমো এবং লুসি ডাFF-গর্ডন: বিতর্কের মুখে পড়া এক দম্পতি

স্যার কসমো ডাFF-গর্ডন এবং তার ফ্যাশন ডিজাইনার স্ত্রী লুসি ডাFF-গর্ডন ছিলেন টাইটানিকের প্রথম শ্রেণীর যাত্রী। যখন লাইফবোট নম্বর ১ নামানো হয়, তখন তারা খুব কম সংখ্যক যাত্রী নিয়েই সেটি ছাড়িয়ে চলে যান (মাত্র ১২ জন যাত্রী, যেখানে ৪০ জন বসার কথা ছিল)। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তারা অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে লাইফবোটের ক্রুদের প্রভাবিত করেছিলেন যেন তারা আরও মানুষকে উদ্ধারের জন্য ফিরে না আসে। যদিও তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন, এই ঘটনাটি টাইটানিকের মর্মান্তিকতার মাঝেও শ্রেণীগত বৈষম্য এবং মানব চরিত্রের অন্ধকার দিকটি তুলে ধরে।

৩. বেঞ্জামিন গুগেনহেইম: শেষ মুহূর্তের ভদ্রতা ও আত্মত্যাগ

আমেরিকান ধনী ব্যবসায়ী বেঞ্জামিন গুগেনহেইম ছিলেন টাইটানিকের একজন প্রথম শ্রেণীর যাত্রী। জাহাজ যখন ডুবছিল, তখন তিনি এবং তার ভ্যালেট (পরিচারক) লাইফবোটের পরিবর্তে ডাইনিং স্যুটে ফিরে যান। তারা তাদের সেরা পোশাক পরেন এবং ঘোষণা করেন, "আমরা আমাদের সেরা পোশাক পরে ডুবে মরার জন্য প্রস্তুত। পুরুষের জন্য এই শেষ কাজ।" তারা শেষ মুহূর্তেও নিজেদের ভদ্রতা এবং মর্যাদা ধরে রাখার চেষ্টা করেন, যা এক অসাধারণ আত্মত্যাগের উদাহরণ।


https://ojanapothe.blogspot.com/2025/06/blog-post_76.html

৪. মিস্টার এবং মিসেস রেনোল্ডস: নবদম্পতির ভাগ্যের খেলা

অস্কার এবং আনা রেনোল্ডস ছিলেন সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি, যারা তাদের মধুচন্দ্রিমার জন্য টাইটানিকে যাত্রা করছিলেন। আনা লাইফবোটে উঠতে পারলেও, অস্কারকে লাইফবোটে উঠতে দেওয়া হয়নি কারণ তিনি পুরুষ ছিলেন। আনা লাইফবোটে বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু অস্কার ফিরে এলেন না। এটি ছিল হাজার হাজার নবদম্পতির মধ্যে একটি, যাদের স্বপ্ন টাইটানিকের সাথে সমুদ্রের অতলে তলিয়ে গিয়েছিল। তাদের গল্পটি সেই সময়ের সামাজিক নিয়মের এক করুণ উদাহরণ, যেখানে পুরুষের জীবনের চেয়ে নারীর জীবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল।

৫. ইভা হার্ট: এক শিশুর ভয়ঙ্কর স্মৃতি

মাত্র ৭ বছর বয়সী ইভা হার্ট ছিলেন টাইটানিকের একজন যাত্রী। তিনি তার মা ও বাবার সাথে যাত্রা করছিলেন। ইভা তার বাবা উইলিয়াম হার্টকে শেষবারের মতো বিদায় জানান, যখন তিনি তার মা এবং তাকে লাইফবোটে তুলে দেন। উইলিয়াম টাইটানিকের সাথে ডুবে যান। ইভা হার্ট সারাজীবন সেই রাতের ভয়াবহ স্মৃতি বহন করে চলেছেন। তিনি টাইটানিকের শেষ জীবিত যাত্রীদের একজন ছিলেন এবং বহু বছর ধরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, যা টাইটানিকের ট্র্যাজেডির এক জীবন্ত সাক্ষী হিসেবে কাজ করেছে।

৬. ফ্রান্সিস ডেভিস মিল্লেট: একজন শিল্পী ও সাংবাদিকের শেষ যাত্রা

ফ্রান্সিস ডেভিস মিল্লেট ছিলেন একজন প্রখ্যাত আমেরিকান শিল্পী, ভাস্কর এবং সাংবাদিক। তিনি টাইটানিকের প্রথম শ্রেণীর যাত্রী ছিলেন। তিনি তার কর্মজীবনে অনেক বিখ্যাত মানুষের প্রতিকৃতি এঁকেছেন। টাইটানিকের মর্মান্তিক ঘটনায় তিনিও প্রাণ হারান। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিশ্ব একজন প্রতিভাবান শিল্পীকে হারায়, যার জীবন আর সৃষ্টির আরও অনেক কিছু দেওয়ার ছিল।




৭. কুকুরের গল্প: যারা বেঁচে গিয়েছিল

টাইটানিকে মোট ১২টি কুকুর ছিল, যার মধ্যে ৩টি কুকুর বেঁচে গিয়েছিল। এদের মধ্যে দুটি ছিল পোমেরানিয়ান এবং একটি পেকিনিজ। তাদের ক্ষুদ্র আকার এবং লাইফবোটের কম স্থানের কারণে তারা যাত্রীদের কোলে চড়ে লাইফবোটে উঠতে পেরেছিল। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, চরম বিপর্যয়ের সময়েও কিছু মানুষ তাদের পোষা প্রাণীদের প্রতি কতটা অনুগত ছিলেন।


এই গল্পগুলো টাইটানিকের মানবিকভাবে সমৃদ্ধ দিকটি তুলে ধরে। এটি কেবল একটি প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা ছিল না, এটি ছিল মানব চরিত্রের বিভিন্ন দিক - সাহস, প্রেম, আত্মত্যাগ, এবং কখনও কখনও লোভ ও পক্ষপাতিত্বের এক বিশাল মঞ্চ। প্রতিটি গল্পই টাইটানিকের ট্র্যাজেডিকে আরও গভীর করে তোলে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন