আমাজন জঙ্গলের ইতিহাস

 



আমাজন জঙ্গলের ইতিহাস আমাজন জঙ্গল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং জীববৈচিত্র্যপূর্ণ রেইনফরেস্ট। এর ইতিহাস কোটি কোটি বছরের পুরোনো এবং এটি মহাবিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক অঞ্চল।


আমাজন জঙ্গলের গঠন ও বিবর্তন

১. ইউসিন যুগ (প্রায় ৫৬ থেকে ৩৩.৯ মিলিয়ন বছর আগে): ধারণা করা হয়, আমাজন রেইনফরেস্টের জন্ম হয়েছিল ইউসিন যুগে। এই সময়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে আসে এবং আটলান্টিক মহাসাগর যথেষ্ট প্রশস্ত হয়। এর ফলে আমাজন অববাহিকায় একটি উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু তৈরি হয়, যা রেইনফরেস্ট গঠনের জন্য উপযুক্ত ছিল।

২. আন্দিজ পর্বতমালার উত্থান (প্রায় ১৫ মিলিয়ন বছর আগে): দক্ষিণ আমেরিকা এবং নাজকা টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে আন্দিজ পর্বতমালা গঠিত হতে শুরু করে। এই পর্বতমালা পূর্বমুখী নদীর প্রবাহকে বাধা দেয় এবং আমাজন অববাহিকায় একটি বিশাল স্বাদু পানির হ্রদ তৈরি হয়, যা সোলিমোয়েস বেসিন নামে পরিচিত।

৩. আমাজন নদীর জন্ম (প্রায় ১০-১১ মিলিয়ন বছর আগে): আন্দিজ পর্বতমালার উত্থানের সাথে সাথে এই বিশাল হ্রদের পানি পূর্ব দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে, যা আজকের আমাজন নদীর জন্ম দেয়। এই নদী হিমালয়ের মতো পর্বতমালা থেকে প্রচুর পলি বহন করে নিয়ে আসে, যা আমাজন অববাহিকার উর্বর মাটি তৈরিতে সাহায্য করে এবং রেইনফরেস্টের বৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।

৪. হিমবাহ যুগ (শেষ ২ মিলিয়ন বছর): হিমবাহ যুগে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে আমাজনের কিছু অংশ তৃণভূমি (savanna) তে পরিণত হয়েছিল। তবে, জলবায়ু আবার আর্দ্র হওয়ার সাথে সাথে রেইনফরেস্ট পুনরায় প্রসারিত হয়।https://ojanapothe.blogspot.com/2025/06/blog-post_34.html


জীববৈচিত্র্যের বিকাশ

আমাজন জঙ্গলের জীববৈচিত্র্য কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে বিকশিত হয়েছে। এখানে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন গাছ, ১৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪২ লক্ষ ৫০ হাজার প্রজাতির পোকামাকড়, ৪২৮ প্রজাতির উভচর, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। আমাজন নদীতে ৩০০০ প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী বাস করে। বিজ্ঞানীরা প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে চলেছেন।

আন্দিজ পর্বতমালা এবং আমাজন নদীর শাখা-প্রশাখা প্রাকৃতিক বাধা তৈরি করে বিভিন্ন প্রজাতির বিবর্তনে সাহায্য করেছে, যা এই অঞ্চলের অতুলনীয় জীববৈচিত্র্যের কারণ।


মানুষের ইতিহাস ও আমাজন

হাজার হাজার বছর ধরে আমাজন জঙ্গলে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে। তারা এই বনের সাথে এক সুরে জীবনযাপন করেছে, এর সম্পদ ব্যবহার করে সংস্কৃতি ও জীবনধারা গড়ে তুলেছে। আমাজনকে প্রায় ১১,০০০ বছর ধরে মানুষের দ্বারা প্রভাবিত করা হয়েছে, যেখানে বন বাগান তৈরি এবং 'টেরা প্রেটা' (উর্বর কালো মাটি) তৈরির মতো অভ্যাসগুলি বনের গঠনে ভূমিকা রেখেছে।

১৫ শতকে ইউরোপীয়দের আগমনের পর থেকে আমাজনের ইতিহাস বদলে যায়। রাবার বুমের সময় (১৯শ শতাব্দীর শেষ থেকে ২০শ শতাব্দীর শুরু) বন উজাড় এবং আদিবাসীদের উপর শোষণ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে, কৃষিকাজ, খনিজ উত্তোলন এবং কাঠ সংগ্রহের জন্য ব্যাপক হারে বন উজাড় হচ্ছে, যা এই অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
আমাজন পৃথিবীর জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং প্রচুর অক্সিজেন উৎপন্ন করে, যে কারণে একে প্রায়শই 'পৃথিবীর ফুসফুস' বলা হয়। তবে, বর্তমানে বন উজাড়ের কারণে এটি কার্বন শোষণ করার পরিবর্তে কার্বন নির্গমনের উৎসে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
আমাজন জঙ্গল শুধু একটি বন নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস, যা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে চলেছে এবং এখনো আমাদের অনেক অজানা রহস্য ধারণ করে আছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন