রহস্যময় ডায়েরি

 



পুরনো ডায়েরির রহস্য: ভূমিকা

শান্তিনিকেতনের নিরিবিলি ছায়ায়, যেখানে বাতাস বয়ে আনে পুরনো সুর আর স্মৃতির রেশ, সেখানেই একটি জীর্ণ বাংলোতে আশ্রয় খুঁজেছিল তরুণী লেখক তানিয়া। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, নির্জনতার কোলে বসে সে তার নতুন গল্পের প্লট বুনতে চেয়েছিল। বাংলোটি ছিল তার বাবার পুরনো বন্ধু, অধ্যাপক রায়ের পারিবারিক সম্পত্তি, আর এর প্রতিটি ধুলো জমা কোণে যেন এক অব্যক্ত নীরবতা লুকিয়ে ছিল।

একদিন, লেখালেখির ফাঁকে বাংলোর পুরনো লাইব্রেরির তাকে হাতড়াতে গিয়ে তানিয়া হাতে পায় একটি শতবর্ষী ডায়েরি। হলদে হয়ে যাওয়া পাতা, মলাটের ওপর রহস্যময় ছাপ – ডায়েরিটা যেন নিজের ভেতরে এক অজানা জগৎ লুকিয়ে রেখেছিল। এ ছিল অধ্যাপক রায়ের বাবার ডায়েরি, যাঁর প্রথম পাতায় লেখা একটি লাইন তানিয়ার মনে গভীর ছাপ ফেলে গেল: "যদি কেউ এই ডায়েরি পড়ে, তবে জেনে রেখো, এর প্রতিটি অক্ষরে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর সত্য।"


https://ojanapothe.blogspot.com/2025/06/blog-post_74.html


সেই মুহূর্ত থেকেই তানিয়ার নিছক এক শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে থাকার উদ্দেশ্য বদলে গেল এক অদম্য অনুসন্ধানে। সে জানত না, এই ডায়েরি তাকে টেনে নিয়ে যাবে এক পরিবারের গভীর রহস্যের দিকে, যেখানে অতীত আর বর্তমানের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসবে এক দীর্ঘদিনের চাপা পড়া কান্না আর এক অতৃপ্ত আত্মার মুক্তির আকুতি। বাংলোর নীরবতা আর কুয়োর গভীর থেকে ভেসে আসা সেই রহস্যময় কান্নার আওয়াজ – এ সবই যেন এক মহৎ উদ্দেশ্য পূরণের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।


পুরনো ডায়েরির রহস্য: সমাধান

সেই রাতে তানিয়া আর ঘুমোতে পারল না। সোনার মূর্তির পেছনের প্রতীকগুলো তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করছিল। সে ডায়েরির পাতা উল্টাতে লাগলো, খুঁজতে লাগলো এমন কোনো সূত্র যা এই প্রতীকের অর্থ উন্মোচন করতে পারে। অনেক খোঁজার পর, ডায়েরির শেষ পাতায় সে কিছু আঁকা ছবি খুঁজে পেল, যা সেই প্রতীকগুলোর সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। ছবিগুলোর নিচে কিছু অদ্ভুত শব্দ লেখা ছিল।

তানিয়া বুঝতে পারল, এগুলো কোনো ভাষা নয়, বরং সংগীতের স্বরলিপি। ডায়েরির লেখক, অর্থাৎ অধ্যাপক রায়ের বাবা, একজন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তানিয়া সাথে সাথে তার ফোন বের করে সেই স্বরলিপি বাজানোর চেষ্টা করল। যখনই সে সুরটি বাজাতে শুরু করল, বাংলোর ভেতর এক অদ্ভুত কম্পন শুরু হলো। দেয়ালের পুরনো পেইন্টিংগুলো কাঁপতে লাগল, আর সেই কুয়ো থেকে আসা কান্নার আওয়াজ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।

তানিয়া দ্রুত কুয়োর কাছে ছুটে গেল। এবার কান্নার আওয়াজটা ভিন্ন মনে হলো—যেন এটি কোনো সুরের অংশ। তানিয়া মোবাইলে বাজানো সুরটি কুয়োর দিকে তাক করে ধরতেই এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। কুয়োর ভেতরের অন্ধকার ধীরে ধীরে ফিকে হতে লাগল, আর দেখা গেল, কুয়োর গভীরে কোনো রত্ন নয়, বরং একটি সুড়ঙ্গের মুখ!

তানিয়া ভয় পেলেও কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে গেল। সে টর্চলাইট জ্বালিয়ে সুড়ঙ্গের ভেতরে প্রবেশ করল। সুড়ঙ্গটি বেশি লম্বা ছিল না। একটু এগোতেই সে একটি ছোট ঘরের মতো জায়গায় পৌঁছাল। ঘরটির মাঝখানে একটি পাথরের বেদি, আর বেদির উপর একটি ঝাপসা আয়না রাখা আছে। আয়নার পেছনে কিছু প্রাচীন যন্ত্রাংশ দেখা যাচ্ছে।

তানিয়া আয়নার দিকে এগিয়ে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই তার নিজের প্রতিবিম্বের বদলে ভেসে উঠল এক নারীর মুখ। সেই নারী কাঁদছে, আর তার চোখে এক গভীর শূন্যতা। তানিয়া বুঝতে পারল, এই কান্নার আওয়াজ সেই নারীরই। কিন্তু কে এই নারী?

ঠিক তখনই তানিয়ার মোবাইল বেজে উঠল। অধ্যাপক রায় ফোন করেছেন। তানিয়া তাকে সবকিছু খুলে বলল। অধ্যাপক রায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি জানালেন, সেই জমিদার, যার বাংলোতে তারা এখন আছেন, তার একটি মেয়ে ছিল। জমিদার ছিল খুব নিষ্ঠুর। সে তার মেয়েকে জোর করে এমন এক লোকের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিল যাকে মেয়েটি ভালোবাসত না। মেয়েটি সেদিন কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তবে তার আত্মা নাকি কুয়োর গভীরে আটকা পড়েছিল।

অধ্যাপক রায়ের বাবা সেই আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সঙ্গীতই পারে আত্মাকে মুক্তি দিতে। তিনি হয়তো এই সুড়ঙ্গের গোপন কথা জানতে পেরেছিলেন এবং সেই আয়নার মাধ্যমে সেই আত্মার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি হয়তো কোনোভাবে সফল হতে পারেননি।

https://ojanapothe.blogspot.com/2025/06/blog-post_82.html

তানিয়া আবার সেই স্বরলিপি বাজাতে শুরু করল, কিন্তু এবার আয়নার দিকে তাকিয়ে সেই নারীকে উদ্দেশ্য করে। সুরের সাথে সাথে নারীর কান্না ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। তার মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি দেখা দিল। আয়নার প্রতিবিম্বটা ফিকে হয়ে গেল, আর তারপর পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল।

কুয়োর দিক থেকে আসা কান্নার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। বাংলোতে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এলো। তানিয়া বুঝতে পারল, সে এক দীর্ঘদিনের আটকে থাকা আত্মাকে মুক্তি দিতে পেরেছে। পুরনো ডায়েরির রহস্য শুধু একটি রত্নের গল্প ছিল না, এটি ছিল এক অব্যক্ত বেদনা আর মুক্তির আকুতির গল্প।

তানিয়া যখন বাংলো থেকে বেরিয়ে এলো, তখন তার মন শান্ত। সে তার নতুন গল্পের জন্য শুধু একটি প্লটই নয়, এক অসামান্য অভিজ্ঞতাও পেয়েছিল। বাংলোটা এখন আর রহস্যময় বা ভুতুড়ে নয়, বরং এক শান্ত আবাস, যেখানে একটি আত্মা অবশেষে মুক্তি পেয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন