গভীর রাত। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার একটানা শব্দ। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু পথটা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমি, আর আমার কাকা।
ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প:
শ্মশান কালীর জাগ্রত রাত:
গভীর রাত। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার একটানা শব্দ। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু পথটা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমি, আর আমার কাকা। আমরা ফিরে আসছিলাম পাশের গ্রাম থেকে, যেখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান ছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশে চাঁদ নেই, তারাগুলোও মেঘের আড়ালে ঢাকা। একমাত্র ভরসা ছিল কাকার হাতে ধরা লণ্ঠনের মিটিমিটি আলো।
গ্রামের শেষের দিকে একটা ছোট শ্মশান। সেখানে একটা পুরোনো বটগাছ আছে, আর বটগাছের নিচে একটা ছোট্ট শ্মশান কালী মন্দির। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে, এই মন্দিরটা নাকি খুবই জাগ্রত। আর শ্মশানটা নিয়েও অনেক ভয়ের গল্প প্রচলিত আছে। আমরা যখন শ্মশানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, কাকা হঠাৎ চুপ করে গেলেন। লণ্ঠনের আলোতে তাঁর মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল।
"কী হলো কাকা?" আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম।
কাকা কোনো উত্তর দিলেন না, শুধু তাঁর হাত দিয়ে আমাকে থামতে ইশারা করলেন। আমি তাঁর ইশারা অনুসরণ করে দাঁড়িয়ে গেলাম। শ্মশানের দিক থেকে একটা চাপা গোঙানির শব্দ আসছিল। প্রথমে মনে হলো যেন কোনো পশু চিৎকার করছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম, না, এটা কোনো পশুর শব্দ নয়। এটা যেন মানুষের গোঙানি!
শব্দটা ক্রমশ বাড়তে শুরু করলো। মনে হচ্ছিল, যেন কেউ খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমি আর কাকা ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাকা লণ্ঠনটা শক্ত করে ধরে আছেন, আর তাঁর হাত কাঁপছে।
হঠাৎ করেই, গোঙানির শব্দটা তীব্র চিৎকার হয়ে উঠল। আর সেই চিৎকারের সাথে সাথে, শ্মশানের দিক থেকে একটা অদ্ভূত আলো দেখা গেল। লালচে একটা আলো, যেটা নিচু হয়ে মাটির উপর দিয়ে ভেসে আসছিল। আলোটা যত কাছে আসছিল, তত আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, ওটা আসলে কোনো আলো নয়। ওটা ছিল একটা রক্তের ধারা! সেই রক্তের ধারা মাটির উপর দিয়ে আমাদের দিকেই গড়িয়ে আসছে।
https://ojanapothe.blogspot.com/2025/06/blog-post_72.html
আমি আতঙ্কে কাকার হাত চেপে ধরলাম। কাকা এবার অস্ফুটে বললেন, "কালী... কালী...!"
ঠিক সেই মুহূর্তে, রক্তের ধারাটা শ্মশান কালী মন্দিরের সামনে গিয়ে থামল। আর তারপর, সেই রক্তের ধারা থেকে ধোঁয়ার মতো কিছু একটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করলো। ধোঁয়াটা ধীরে ধীরে একটা আকৃতি নিতে লাগলো। সেটা একটা মানুষের আকৃতি। একটা লম্বা, কালো আকৃতি, যার চোখ দুটো লাল জ্বলজ্বল করছে। তার লম্বা নখগুলো যেন অন্ধকারে চকচক করছিল।
আমাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। আমরা চোখে যা দেখছিলাম, তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সেই কালো আকৃতিটা ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। তার প্রতিটি পদক্ষেপে, মাটির উপর থেকে একটা স্যাঁতসেঁতে শব্দ উঠছিল, যেন কোনো পচা কিছু মাটির উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আমি আর কাকা জ্ঞান হারানোর উপক্রম। পালাতে চাইছিলাম, কিন্তু পা দুটো যেন মাটির সাথে আটকে গিয়েছিল। কালো আকৃতিটা যখন আমাদের থেকে কয়েক হাত দূরে, তখন একটা বিকট হাসি শোনা গেল। সেই হাসিটা এতটাই বীভৎস ছিল যে আমাদের মনে হলো, যেন আমাদের বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
তারপর, আকস্মিকভাবে, সেই কালো আকৃতিটা বাতাসে মিলিয়ে গেল, যেমনটা এসেছিল। রক্তের ধারাটাও অদৃশ্য হয়ে গেল। চারিদিকে আবার সেই গভীর নীরবতা। শুধু ঝিঁঝি পোকার শব্দ।
আমরা দু'জনই সেখানেই লুটিয়ে পড়লাম। কাকা কাঁপছিলেন, আর তাঁর চোখ দুটো তখনও বিস্ফারিত। আমি শুধু অনুভব করছিলাম, আমার সারা শরীর ভিজে গেছে ঘামে, আর আমার হৃদপিণ্ডটা যেন উন্মত্ত গতিতে ছুটছে।
কোনোমতে আমরা দু'জন উঠে দাঁড়ালাম। সেই রাতের পর থেকে আমরা আর কখনও রাতের বেলায় ওই শ্মশানের ধারকাছ দিয়ে যাইনি। আজও সেই রাতের কথা মনে পড়লে আমাদের গা শিউরে ওঠে। শ্মশান কালীর জাগ্রত রাত, আর সেই অশরীরী আত্মার ভয়ঙ্কর দর্শন – এই স্মৃতি আমরা কোনোদিনও ভুলতে পারিনি।